১৯৯৬ সালে মস্কোতে আনুষ্ঠানিকভাবে আধ্যাত্মিক উন্নয়নে ‘ইহালাস’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী তহবিলের কার্যক্রম শুরু হয়। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী এমন ধর্মানুরাগীদের জন্য ইসলাম শিক্ষার আয়োজন করার লক্ষ্য নিয়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই শিক্ষার আসরে যে সব বিষয়বলী থাকে তা হচ্ছে- আকিদা, ফিকাহ, কোরআন, নবীদের ইতিহাস, মহানবীর জীবনাদর্শ, আরবী ভাষা, তাফসির ও আহলাখ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই তহবিলের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন আনওয়ার হাজরাত সালায়েভ। তিনি বলছেন, ‘সবসময় আমাদের ১২০ জন শিশু শিক্ষার্থী থাকে এবং এছাড়াও ৩০০ জন রয়েছেন নিয়মিত শ্রোতা। প্রতিবছরই আসছে নতুন শিক্ষার্থী। সবসময়ই আমাদের নতুন গ্রুপ থাকে। তাছাড়া সর্বদাই পরিবর্তন আনা হয়। নিজেদের শ্রোতাদের সাথে আমাদের কখনও দূরত্ব তৈরি হয় না। হ্যাঁ, যারা ৯০ দশকের দিকে আমাদের এখানে এসেছিলেন, আজও তাঁরা আসেন অথবা নিজেদের সন্তানকে নিয়ে আসেন। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উত্সবের দিনগুলোতে আমাদের শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আমরা ১ টেবিলে বসি।আমাদের তহবিলের সবাই একে অপরের সাথে পারিবারিক সম্পর্কের ন্যায় আবদ্ধ। এ কারণেই আমাদের কাছে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ সহকারে শিখতে আসেন’।
আধ্যাত্মিক অর্থে মিলন ঘটনার অংশ হিসেবে প্রতিবছর শিশু ও বয়ষ্কদের জন্য ‘ইহালাস’ তহবিলের উদ্দ্যোগ রাশিয়ায় ও বিদেশে ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়।
আনওয়ার হাজরাত সালায়েভ বলছেন, ‘বিশেষকরে গ্রীষ্ম মৌসুমে আমাদের এই ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। বর্তমানে আমরা এই কার্যক্রম রাশিয়ার নিজনীগোরাদ অঞ্চলে আয়োজন করতে যাচ্ছি। এ বছর ওই অঞ্চলের ৫০০ শিশু আমাদের কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেছে। ক্রীড়া, শিক্ষা সফর ও নতুনত্বের ওপর পাঠদানের মধ্য দিয়ে শিশুদের ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানদান করা হয়। এর পূর্বে আমরা শিশুদের ৩ সপ্তাহের জন্য ক্রিমে নিয়ে যাই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি আমরা করতে পেরেছি তা হল, পারিবারিক শিক্ষাদানের অন্তর্গত থেকে তহবিলের কল্যাণে প্রাথমিক শিক্ষার একটা স্কুল গড়ে তুলেছি। এই স্কুলে দুই বেলা হালাল খাবার, ধর্মীয় শিক্ষার ওপর বাড়তি পাঠাদান, শিশুদের নামাজ আদায়ে শিক্ষা, কোরান পাঠ ও নিষিদ্ধ কাজ না করার ওপর জ্ঞানদান করা হয়। রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশের মুসলমানদের আধ্যাত্মিক নিয়ন্ত্রণের শর্তাবলী পূরন করেই পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করা হয়েছে।
রাশিয়ার মুসলিম উষ্মার খবরঃ
রাশিয়ার মুফতি পরিষদে ‘রাশিয়ার গনমাধ্যমে ইসলামিক সংস্থা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ কর্মসূচির আয়োজন করে রাশিয়ার মুফতি পরিষদের বিশেষজ্ঞ পরিষদ ও ইসলামিক এ্যানালেটিক্যাল সেন্টার ফিকরা। আয়োজকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে গনমাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায়ের কার্যক্রম পরিচালনা করার অনেক সুযোগ রয়েছে। গোলটেবিল বৈঠকে মুসলমানদের জন্য কয়েকটি মিডিয়া প্রকল্প শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছেঃ টেলি-ভিডিও কোম্পানী ‘ইসলামিক বিশ্ব’, ম্যাগাজিন ‘মুসলমান’, আন্তর্জাতিক সামাজিক যোগাযোগ সাইট ‘সালাম বিশ্ব’, ইসলামিক ম্যাগাজিন ‘নতুন প্রান্ত’, আন্তর্জাতিক সেন্টার ‘আল-ভাসাতিয়ার’ মস্কো কেন্দ্র উদ্বোধন প্রভৃতি। রাশিয়ার মুসলিম উম্মাকে একটি গনমাধ্যমের অন্তর্গত রেখে যোগসূত্র স্থাপনের প্রস্তাবকে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহনকারী সবাই সমর্থন জানায়। মুসলমান সাংবাদিকতার নীতিগত বিষয়বলী নিয়ে পর্যালোচনা করে তা মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে পাঠানো হবে বলে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রাশিয়ার তাতারিস্তানের রুশ ইসলামিক ইনস্টিটিউটের(রিইই)প্রকাশনায় রচিত এক প্যাকেট পাঠ্য বই উরালের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে উপহার দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানের জন্য দেয়া ওই বইগুলোর মধ্যে রয়েছে- হাদিস সূচনা, আবু হানিফের অনুসারে নামাজ আদায়, ইসলামিক বিশ্বাস শিক্ষা, ভাল্গা-উরাল অঞ্চলে মুসলমানদের চিন্তা-ধারার ইতিহাস, কোরআন বিজ্ঞান, চিরাচরিত মুসলিম পরিবারের আইন ও ইসলামিক আইন-কানুন ইত্যাদি। বইগুলির লেখকরা হচ্ছেন রাশিয়ার ইসলামিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষক। উল্লেখ্য, চলতি শিক্ষা বছরে উরালের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিখ্যাত ইসলামিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এটি তত্ত্বীয় উপহার।গত বছরের শরতকালে দুই প্যাকেট বই পাঠানো হয়েছিল।
মার্চ মাসে রুশ ইসলামি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপকেরা ইরাল অঞ্চলের ছাত্রদের জন্য, যারা ইসলামি ধর্মবাদ চর্চা করছে, তাদের জন্য একটা লেকচারের সিরিজের আয়োজন করবেন।
মস্কোয় উত্তর ককেশাস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-প্রধান, ধর্মবাদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ডঃ মাকসুদ সাদিকভের স্মৃতির প্রতি উত্সর্গীকৃত একটি অনুষ্ঠান হয়ে গেল। তিনি গত বছরের জুন মাসে দাগেস্তানের রাজধানী মাখাচকালায় চরমপন্থীদের হাতে খুন হন। ঐ শোকানুষ্ঠানে যোগ দেন রাশিয়ার ইসলামি উচ্চতর শিক্ষায়তনের অধ্যক্ষরা, মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচালন সমিতির প্রতিনিধিরা, রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি প্রশাসনের প্রতিনিধিরা, রাশিয়ার মন্ত্রীসভার ও সামাজিক দপ্তরের প্রতিনিধিরা ও মুসলিম সংবাদ মাধ্যমগুলি. তাদের মধ্যে অনেকেই মাকসুদ সাদিকভের জীবন ও কর্মকান্ডের স্মৃতিচারন করেন, যিনি ছিলেন রাশিয়ায় ইসলামিক শিক্ষাদীক্ষা চর্চার পথিকৃত। ঐ অনুষ্ঠানে যোগদানকারীরা সাদিকোভের স্মৃতিতে প্রতিবছর ইসলামিক শিক্ষাদীক্ষার বিকাশের প্রতি উত্সর্গীকৃত সম্মেলনের আয়োজন করা এবং রাশিয়ার ছাত্রদের জন্য সাদিকভের নামাঙ্কিত বিশেষ পুরস্কার প্রদানের বিষয়ে মস্কো ইসলামি ইনস্টিটিউটের উদ্যোগ সমর্থন করেছে।
সেন্ট-পিটার্সবার্গে মুসলিম নার্সারী খোলা হচ্ছে। ২ থেকে ৬ বছর বয়সী ছোট্ট মুসলিম বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্তুতির কথা মাথায় রেখে বিশেষ শিক্ষা দেওয়া হবে। শিশুরা সেইসাথেই আরবী ও ইংরাজী ভাষা শিখবে, ইসলামের ইতিহাসের সাথে পরিচিত হবে। একটা ক্লাসে পনেরো জনের বেশি শিশুকে নেওয়া হবে না – রুশী ভাষা জানা যে কোনো জাতের শিশুদের সেখানে ভর্তি করা যাবে।খাদ্যের তালিকায় থাকবে শুধুমাত্র হালাল করা খাদ্যদ্রব্য।
রুশ বিজ্ঞান এ্যাকাডেমির প্রাচ্যতত্ত্ব ইনস্টিটিউটে সম্প্রতি উদ্বোধন করা হল শারিয়তের বিষয়ে প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ লেওনিদ স্যুকিয়াইনেনের লেখা ‘বিশ্বায়ন ও ইসলামি দুনিয়াঃ আধুনিক ঐস্লামিক আইনগত চিন্তাভাবনার মূল্যায়ন’ নামক বইয়ের।
রুশী বিজ্ঞানীর মতে, এখন মুসলমান বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশ্বায়নের বিষয়ে তিনটি অভিমুখ বিরাজ করছে।
প্রথমটি – রক্ষণশীল, কড়া, বাদবিচার ছাড়াই আধুনিক বিশ্বের সাথে সম্পর্কিত সবকিছু বাতিল করে দেওয়া। এই অভিমুখীরা বলে – এ সবকিছু অধর্মীয়, পাশ্চাত্য দুনিয়া কতৃক চাপিয়ে দেওয়া, সুতরাং কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারা কিএকটা ঐস্লামিক প্রকল্পের কথা বলে, - কি সেই প্রকল্প? কেউ সঠিক জানে না। কিন্তু মুখ্য ব্যাপার হল – কিন্তু যা কিছু বিশ্বায়নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তারা সেই সবকিছুকে অস্বীকার করে। দ্বিতীয় অভিমুখ – বিশ্বায়নকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা ও শুধুমাত্র বিশ্বায়ন নয়, ইসলামি সমাজের পশ্চিমীকরন।
তবে রুশী বিজ্ঞানীর মতে, আরও আছে তৃতীয় অভিমুখ – সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত এই অভিমুখ যবনিকার আড়ালে ছিল এবং সক্রিয়ভাবে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী প্রচার করেনি।
এটা পরিমিত ইসলামিক চিন্তাধারা, সংযত, মধ্যমপন্থী। লেওনিদ স্যুকিয়াইনেন বলছেন, যে এই সব চিন্তাধারা ইসলামি নিয়মকানুনের ভিত্তিতে সৃষ্টি, যা বহু শতাব্দী ধরে প্রনয়ণ করা হয়েছে, কিন্তু আজকের বাস্তবের সাথে তাকে খাপ খাইয়ে নেওয়া হচ্ছে। এই অভিমুখ কিছু কিছু বদ্ধ ধারনা পরিত্যাগ করার আহ্বাণ জানাচ্ছে, যেমন, পৃথিবীর গোটা ভূখন্ডকে ইসলামি ভূখন্ড ও যুদ্ধের ভূখন্ডে দ্বিবিভক্ত করা। এখানে বিজ্ঞানীর মতে, ইসলামের বুনিয়াদের প্রতি একান্ত বিশ্বাস রেখেও, সেইসঙ্গেই আধুনিক জীবনের প্রতি নমনীয় মনোভাব প্রকাশ করা হচ্ছে। এই অভিমুখী ধারা ক্রমশঃই জোরদার হচ্ছে, বহু দেশে, যেমন কুয়েতে সরকারী স্তরে এই দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলছেন, যে তার বইয়ে তিনি যে এই অভিমুখেরই সমর্থক, সেটা গোপন করেন নি।